করোনা জয়ী ৩৪ পুলিশে ফের কর্মচঞ্চল গাছা থানা

 

শতাব্দী আলম, গাজীপুর থেকে ফিরে : খসরু খান কথা শুরু করতে আবেগ আপ্লুত হচ্ছিলেন, ‘ ভাই বুঝাতে পারবো না ১৭ এপ্রিল যখন জানতে পারলাম আমার ‘করোনা পজিটিভি’ খুব ভয় পেয়েছিলাম। না জানি কি হয়! পুলিশে চাকুরীর সুবাদে আমাদের মনোবল অন্যদের তুলনায় শক্ত, তবু মন-তো। পরিবারের কথা ভেবে খুব খারাপ লেগেছিলো।’ কথা বলতে বলতে শান্ত বিনয়ী পুলিশ অফিসার মালেক খসরু খানের গলা ধরে আসছিল।

একটি ছাদের নীচে ৩৪ জন মানুষ করোনা আক্রান্ত ছিল। তারা প্রত্যেকেই এখন সুস্থ্য। বলছি, গাজীপুর মেট্রোতে গাছা থানার ৩৪ জন পুলিশ সদস্যের কথা। তারা প্রত্যেকেই করোনা জয়ী। পুনরায় কাজে যোগদান করেছেন। আবার কর্মচঞ্চল গাছা থানা।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ আনোয়ার হোসেন পিবিএকে জানান, গাছা থানার ৩৪ জন সদস্য আক্রান্ত হবার পর কিছুদিন থানার কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছিল। আক্রান্ত সদস্যরা আইসোলেশনে থেকেছেন। সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সহায়তা এবং পুলিশ সদস্যদের দৃঢ় মনেবলের কারনে দ্রুতই তারা সেরে উঠেছেন। জিএমপির পক্ষ থেকে সর্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখা হয়েছে। তাদের প্রতিদিনের ঔষধ, খাদ্য সামগ্রী, ফলমুল ও প্রয়োজনীয় সহযোগীতা করা হয়েছে।

সেখানে যেতে বুক দুরু দুরু করবে এটাই স্বাভাবিক। হচ্ছিলও তাই। কয়েকদিন যাবৎই যাব যাব করেও কেন যেন আর যাওয়া হয় না। করোনা আইসোলেশনে তাদের অভিজ্ঞতার কথা নিজ কানে শুনার আগ্রহ প্রবলতর হচ্ছিল।

গতকাল রোববার মনে সাহস জুগিয়ে বের হলাম। সোজা বোর্ড বাজার হয়ে গাছা থানায় অফিসার ইনচার্জ মোঃ ইসমাইল হোসেনের কক্ষে প্রবেশ করি। অবশ্য দরজায় দাড়িয়ে পকেটে থাকা স্যানিটাইজার দিয়ে ভালভাবে হাত স্যানিটাইজ করা হয়।
বড় সুবিন্নস্ত কক্ষ। মাঝে বড় একটা টেবিল। সামনে একটি মাত্র চেয়ার। আমি পকেট থেকে টিস্যু নিয়ে চেয়ারটা মুছি। কিছুটা দূরত্বে টেনে বসি। তিনি ভিতরের কক্ষে ছিলেন, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেরুলেন।

ইসমাইল সাহেব আক্রান্ত হননি। তবে সহকর্মীদের ৩৪ জন আক্রান্ত হবার পর তিনি কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। মাশআল্লাহ কোন সমস্যা দেখা দেয়নি, জানালেন।

তিনি জানালেন, ওসি তদন্ত মোঃ মালেক খসরু খান আইসোলেশন থেকে ফিরে কাজে যোগদান করেছেন। তিনি নিজ কক্ষে রয়েছেন। তার কাছ থেকে বিস্তারিত জানা যাবে।

মনে যে আতংক ছিল মুহুর্তেই উবে গেলো। এই ভেবে মনে মনে পুলিশ সদস্যদের জন্য গর্ব হলো যে, করোনা তাদের কর্তব্য পালনে বাধাগ্রস্ত করেছিল। তারা করোনা জয় করে কর্তব্যে নিয়োজিত। আবার সেই করোনা প্রতিরোধে কাজ করছেন।

খসরু সাহেব এমনিতে শান্ত বিনয়ী মানুষ। কয়েকদিনের একাকিত্বে নিজেকে যেন আরো বেশী শুধরে নিয়েছেন। চেহারায় সৌম্য দর্শন ভাবটা এসেছে।

ভাই কেমন আছেন! তিনিই প্রথম জানতে চাইলেন।
আমি উত্তর দিলাম, ভাল আছি, আপনাদের খোঁজ খবর নিতে এসেছি। এখন কেমন আছেন ? একথা জানতে তিনি শুরুর ঐসব কথা বলেন।
তিনি একের পর এক বলে গেলেন করোনা কালের অভিজ্ঞতা।
তিনি জানান, করোনা প্রাদূর্ভাব শুরু হবার পর থেকেই মানুষকে সচেতন করতে মাঠে কাজ করেছেন। এর মাঝে শ্রমিক অধ্যুষিত গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে সচেতনতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন। এর মাঝেই গত ১৭ এপ্রিল তার করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়।

খসরু খান বলেন, প্রথমে থানার একজন সদস্য করোনা আক্রান্ত হন। পরে সব সদস্যের নমুনা পরীক্ষা করলে ৩৪ জনের দেহে করোনা শণাক্ত হয়।

চিকিৎসকের পরামর্শে, এদের মাঝে ১৪ জনকে ঢাকা পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাকীরা হোম আইসোলেশনে থাকা শুরু করেন। তিনিও হোম আইসোলেশনে ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরে নিজের এবং অন্যদের রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছেন।
ঘটনা জানার সাথে সাথে জিএমপি কমিশনার মহোদয় ফোন দেন। তিনি সাহস জোগান। বার বার বলেছেন, মনোবল শক্ত রাখতে হবে। ভেঙে পরলে চলবে না। সব রকম সহযোগীতা করা হবে।

উর্দ্ধতন পুলিশের অনেকেই ফোন দিয়ে সাহস দিচ্ছিলেন। মানসিকভাবে তার খারাপ লেগেছে, তবে ভেঙে পরেননি। সহকর্মী এবং আত্মীয় স্বজনের ফোনে মনোবল অনেক বাড়ে।

খসরু খান আইসোলেশনের ব্যপারে জানান, তিনি বাসার একটি কক্ষে নিজেকে আইসোলেট করেন। ঐ ক’দিন তিনি নিজেই সব করেছেন। প্রতিদিন সকাল বেলা উঠে পূর্বের দিনের জামা কাপড় চেঞ্জ করা হতো। সাথে বিছানার চাদর বালিশের কভার এসবও। তারপর ডেটল ও গুড়ো সাবানে এসব ভিজিয়ে নিজেই পরিস্কার করেছেন। কক্ষের মেঝে এবং বসার স্থান ডেটল মিশ্রিত পানি দিয়ে সকাল বিকাল মুছে নিতেন।

খাবার খেতে আরো বেশী সর্তকতা অবলম্বন করেছেন। তার স্ত্রী খাবার ওয়ান টাইম বক্সে ভরে কক্ষের দরজার সামনে রেখে দিতেন। তিনি খাবার খেয়ে বক্সসহ উচ্ছিষ্ট সবকিছু একটি পলিতে ভালভাবে প্যাকেট করেছেন। পরে পরিচ্ছন্ন কর্মী এলে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

চিকিৎসকের পরামর্শে খাবারের তালিকায় যেসব খাবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় যেমন-দুধ, ডিম, কলা, লেবু, মাছ, মাংশ এসব বেশী বেশী খেতে হয়েছে। কমিশনার মহোদয় নিয়মিত এসব ফলমুল ও খাবার পাঠিয়েছেন। সাথে ঔষধ চলছিলো।
গরম পানি পানের ব্যপারে ডাক্তারের বিশেষ নির্দেশ ছিলো। গরম পানির সাথে লেবুর রস, আদা, লঙ, এলাচ, দারুচিনি, লব্ঙ্গ, কালোজিরা মিশিয়ে খেয়েছেন। দিনে ২/৩ লিটার এসব মিশ্রিত গরম পানি পান করেছেন।

তিনি বলেন, ৪/৫ দিন পর গলায় পোল্টা পোল্টা মনে হতে লাগলো। গলা চুলকে সামান্য খুশখুশি কাশও ছিল। গায়ের তাপমাত্রাও বাড়ে। শরীরে ব্যাথাও হয়েছে। তবে ফোনে ডাক্তারের পরামর্শে আরো বেশী সচেতনভাবে মেনে চলতে থাকেন।

তিনি বলন, কমিশনার মহোদয়সহ পুলিশের সহকর্মীরা অনেকেই নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন। সাহস জোগাচ্ছিলেন।

পরিবারের সদস্যদের সার্বক্ষণিক তদারকি এবং সহকর্মীদের উৎসাহব্যঞ্জক টেলিফোন মনে সাহস যুগিয়েছে। মনে সাহস ছিলো। মনোবল শক্ত ছিলো।

২৮ এপ্রিল প্রথমবার পরীক্ষায়ই করোনা নেগেটিভ আসে। তারপর আরো দুইবার। শেষে ৮ মে তারিখেও করোনা নেগেটিভ হয়। সেদিন থেকেই কাজে যোগদান করা হয়েছে।

মালেক খসরু বলেন, করোনাকে ভয় পেলে চলবে না। সচেতনতা এবং সর্তকতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে। মনোবল ধরে রাখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক নিয়ম মেনে চললেই করোনা জয় করা খুব সহজ। তবে প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধই উত্তম।

পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোঃ মালেক খসরুর মত গাছা থানার ৩৪ জন সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। ঐসব বীর যোদ্ধারা সবাই করোনা জয়ী। তারা আবার করোনা প্রতিরোধে সম্মুখ যোদ্ধা হিসাবে আত্মনিয়োগ করেছেন।

পুলিশ কমিশনার আরো বলেন, ‘করোনা প্রতিরোধের সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসাবে আবার কাজে ফেরায় তাদের অভিনন্দন। পাশাপাশি তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে দুই ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। একদল সার্বক্ষণিক থানা কার্যালয়ে অবস্থান করবে। যাদের বাহিরে কাজ, তারা বিশেষ নিরপত্তা ব্যবস্থা যেমন-পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, সানগ্লাস, নিরাপত্তা জুতা পরিধান করে তবে বাহিরে যাবে। তাছাড়া সবাইকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

এটা মানব সবার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত , করোনা প্রতিরোধে নিয়োজিত থেকে আক্রান্ত হলেন। করোনা জয় করলেন। আবার করোনা প্রতিরোধের যুদ্ধে নিজেকে শামিল করেছেন। বাংলাদেশ পুলিশের এইসব যোদ্ধাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অভিবাদন।

পিবিএ/শতাব্দী আলম

আরও পড়ুন...