পিবিএ ডেস্ক: কাশ্মীরের জনগণ ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে; মোদি সরকারের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও সেখানকার বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। কারফিউ জারি রেখে সংবাদমাধ্যম ও ইন্টারনেটসহ মানুষের চলাচলের ওপর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং বিপুল সংখ্যক অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও বিক্ষিপ্তভাবে বিক্ষোভের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কাশ্মীরবাসী। এদিকে শ্রীনগরের মহারাজা হরি সিং হাসপাতাল (এসএমএসএইচ) পরিদর্শনের ভিত্তিতে ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে ধারণা করা যাচ্ছে, আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভের আশঙ্কা দেখলেই বেসামরিক জনসাধারণের ওপর ছররা গুলি ছুড়ছে। বিক্ষোভ দমনের অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত ৫শ’রও বেশি রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী।
টেলিফোন ও ইন্টারনেটের উপর নিয়ন্ত্রণসহ কাশ্মিরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অচলাবস্থা তৈরি হওয়ায় সেখানকার পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র উপস্থাপন করাটা কঠিন হয়ে পড়েছে সংবাদকর্মীদের জন্য। ৮ আগস্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, এরপরও অঞ্চলটিতে বিক্ষিপ্তভাবে বিক্ষোভ হচ্ছে। শ্রী মহারাজা হরি সিং হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে ছররা গুলিবিদ্ধ আট ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মার্কিন সংবাদমাধ্যম হাফিংটন পোস্টের প্রতিবেদক। এদের মধ্যে সাতজন পুরুষ ও একজন নারী রয়েছেন।
হাসপাতালের রোগীরা জানিয়েছেন, তারা শ্রীনগরের নৌহাট্টা এলাকায় বিক্ষোভ হতে দেখেছেন। তাদের দাবি, সেখানে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের উপর ছররা গুলি ছুড়েছে। ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসক হাফিংটন পোস্টকে জানান, গত তিন দিনে প্রায় ৪০ জন ছররা গুলিবিদ্ধ মানুষকে চিকিৎসা দিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শ্রীনগরের এলাহি বাগ এলাকার বাসা থেকে বের হয়ে পার্শ্ববর্তী খেলার মাঠের দিকে যাচ্ছিলো আসরার খান নামে একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। তবে খেলার মাঠে না গিয়ে শেষ পর্যন্ত তার গন্তব্য হয়েছে হাসপাতাল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনীর সেনারা কিশোর আসরারকে লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাস শেল ছুড়েছিলো। তার শরীরে ছররা গুলিরও আঘাত লেগেছে।
রক্তাক্ত অবস্থায় মোটরসাইকেলে করে আসরারকে নিয়ে যাওয়া হয় শেরে কাশ্মির ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স (এসকেআইএমএস) হাসপাতালে। সিটি স্ক্যানে দেখা যায়, তার মাথায় অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হচ্ছে। রাতভর চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার চালান। তার শারীরিক অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। চিকিৎসককে উদ্ধৃত করে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, প্রাণে বেঁচে গেলেও ওই কিশোর তার দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে।
শুক্রবার কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করা হলেও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আবদুল্লাহসহ ৫ শতাধিক নেতাকর্মী এখনও সরকারি হেফাজতেই রয়েছেন। যে কোনও ধরনের প্রতিবাদ বা সমাবেশ এড়ানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম কাশ্মির মিডিয়া সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অল পার্টিজ হুরিয়াত কনফারেন্স-এর চেয়ারম্যান সৈয়দ আলি গিলানি এবং হুরিয়াত ফোরামের চেয়ারম্যান মিরওয়াইজ উমর ফারুকসহ সংগঠনের প্রায় সব নেতাকে গৃহবন্দি কিংবা জেলে আটক রাখা হয়েছে। কাশ্মিরের আনাচে কানাচে ভারতীয় সেনাদের প্রবল উপস্থিতি রয়েছে। শ্রীনগর শহরকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে ভারতীয় সেনারা। জম্মু, কাঠুয়া, সাম্বা, পুঞ্চ, দোদা, কিশটোয়ার, উদামপুর ও অন্যান্য এলাকায়ও একই পরিস্থিতি চলছে। এমন অবস্থায় যেন ধূ ধূ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে কাশ্মির উপত্যকা।
চীন ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ এলাকা লাদাখের তিনটি এলাকায়ও বড় জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে দিল্লি। বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটা থেকে কার্গিল, দ্রাস ও সানকু এলাকায় এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে। এসব এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছে সরকার। প্রশাসন জানিয়েছে, কোনও জায়গায় চার জন বা তার বেশি সংখ্যক মানুষের জমায়েত হলেই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
অন্য এলাকা থেকে কাশ্মিরে গমনকারী রাজনীতিবিদদেরও বাধা দেওয়া হচ্ছে। শুক্রবার ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সীতারাম ইয়েচুরি ও তার দলীয় সহনেতা ডি রাজাকে শ্রীনগর বিমানবন্দরে আটকে দেওয়ার পর প্রতিবাদ জানিয়ে টুইট করেছে সিপিআই (এম)। সংবাদসংস্থা পিটিআইকে ইয়েচুরি ফোনে বলেন, ‘ওরা আমাদের একটি আইনি নির্দেশ দেখিয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছে ওরা আমাদের শ্রীনগরে প্রবেশের অনুমতি দেবে না। এতে বলা হয় নিরাপত্তাজনিত কারণেই শহরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমরা এখনও তাদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দুজনই জম্মু ও কাশ্মিরের রাজ্যপালকে অনুরোধ করেছিলাম যাতে আমাদের সফরে কোনও বাধা দেওয়া না হয়। তারপরেও আমাদের আটক করা হয়েছে। আমি আমার অসুস্থ সহকর্মী এবং অন্য সহকর্মীরা যারা ওখানে রয়েছেন তাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম।’
এর আগে বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) কংগ্রেস আইনপ্রণেতা গুলাম নবী আজাদকেও শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হয়। রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা আজাদ কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে শ্রীনগরে গিয়েছিলেন।
বুকারজয়ী ভারতীয় লেখক ও মানবাধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায় কাশ্মিরকে দেখেন ‘একটি পরমাণু যুদ্ধক্ষেত্র এবং পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিকীকরণকৃত এলাকা’ হিসেবে। সেই ২০১৩ সালে ‘আফজাল গুরুর ফাঁসি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য কলঙ্ক’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি বলেছিলেন,‘এখানে [কাশ্মিরে] রয়েছে ভারতের পাঁচ লাখ সৈনিক। প্রতি চারজন বেসামরিক নাগরিকের বিপরীতে একজন সৈন্য! আবু গারিবের আদলে এখানকার আর্মি ক্যাম্প ও টর্চার কেন্দ্রগুলোই কাশ্মিরিদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের বার্তাবাহক।’ ২০১৩ সালের পর আরও ৫ বছর পেরিয়ে গেছে। কাশ্মির সংকটের সমাধানে সেখানে সেনা-সংখ্যা আরও বাড়ানো হয়েছে। দমনপীড়নের পথেই হেঁটেছে ভারতীয় বাহিনী। এর সবশেষ সংযোজন হিসেবে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়ে তাকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তর করেছে মোদি সরকার।
পিবিএ/বাখ