নির্ধারিত হয়নি খালেদা জিয়ার মুক্তির পথ

নাইকো দুর্নীতি মামলায় খালেদার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি ৩১ মার্চ

পিবিএ,ঢাকা: জিয়া চ্যারেটিবেল ট্রাস্ট মামলায় কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়ার ‘মানবিক ও উন্নত চিকিৎসার গ্রাউন্ডে’ জামিন আবেদন মাস দুয়েক আগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ খারিজ করে দেয়ার পর আবারো আইনি পথেই দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তির পথ খুঁজছে বিএনপি। গতকাল আবারো তার জামিন আবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। আজ তা আদালতে তোলা হতে পারে। আবারো এই আবেদনের কি কোনো বিশেষত্ব আছে? বেগম জিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, একবার জামিন আবেদন নাকচ হয়ে গেছে বলে, আর কখনোই আবেদন করা যাবে না বিষয়টি এমন নয়। কোনো মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামিন আবেদনের ক্ষেত্রে আইনি কোনো বাধা নেই। বেগম জিয়া খুবই অসুস্থ। তাই বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য তার জামিন পাওয়ার ভিত্তি এখন আরো জোরোলো হয়েছে।
খালেদা জিয়ার মুক্তির অন্য পথগুলোও আইনি। এ ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তও গুরুত্বপূর্ণ। আইনজীবীরা বলছেন, আদালতে জামিন না পেলে বেগম জিয়া চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারেন। আবার সংবিধানের ৪৯ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিও বেগম জিয়াকে সাজা ও দণ্ড থেকে মুক্তি দিতে পারেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্যারোলে নয়, আইনি পথেই মুক্তি চান বেগম খালেদা জিয়া।

বেশ কিছু দিন ধরেই বেগম জিয়ার কারামুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির ভেতরে আলোচনা আছে উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে চান। এ নিয়ে বিএনপি ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সাথে বিদায়ী বছরের শেষ দিকে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনা অনেক দূর গড়ায়ও। পরে এ বিষয়টি বিএনপির পাঁচ এমপি, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এমনকি পরিবারের পক্ষ থেকেও বেগম জিয়ার সাথে সাক্ষাতে জানানো হয়; কিন্তু বেগম জিয়া তাদের সাফ জানিয়ে দেন, তিনি প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। জামিন তার হক। সাংবিধানিকভাবে এটা তার প্রাপ্য। আইনজীবী নেতাদের জামিনের জন্য লড়াই করতে আহ্বান জানান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর পরই আলোচনা থমকে যায়। এরপর আবারো সপ্তাখানেক ধরে বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা চলছে।

এ দিকে দিন দিন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় বেগম জিয়ার ভাই শামীম এস্কান্দার পরিবারের পক্ষ থেকে বিএনপি প্রধানের সুচিকিৎসায় বিদেশ পাঠানোর জন্য সপ্তাহ দুই আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর জন্য এটাই প্রথম লিখিত আবেদন। বিষয়টি স্বীকার করেন বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ ও বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। আবেদনটি বিবেচনা করা হবে বলে আশা করছে পরিবার।

এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার সেজ বোন সেলিমা ইসলাম বলেছেন, মেডিক্যাল বোর্ড যেন বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারকে সুপারিশ করে সে জন্যই ওই আবেদন করা হয়েছে। আবেদনে আমরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে চেয়েছি। আর বলেছি, খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। কারণ, এটা সম্পূর্ণ সাজানো ও মিথ্যা মামলা। সে জন্যই আমরা নিঃশর্ত মুক্তি চেয়েছি। খালেদা জিয়া বিদেশ যেতে রাজি হবেন কি নাÑ এমন প্রশ্নে সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘তার সম্মতি থাকবে’। জামিন পেলে বেগম জিয়া লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা নেবেন বলেও পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, আদালতের নির্দেশনা পেলে আবারো খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের প্রতিবেদন জমা দেবে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও পরিবারের সদস্যরা আশা করছেন, বেগম জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার সুপারিশ করলে তার জামিন পেতে কোনো সমস্যা হবে না। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য। জানা গেছে, নতুন করে বেগম জিয়ার জামিনের জন্য যে আবেদন করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সরকার যেন কোনো বাদ না সাধে সে জন্য নানামুখী তৎপরতা চলছে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেছেন, জামিন ছাড়াও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১) ধারায়, অর্থাৎ দণ্ড স্থগিত করে সরকার চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনকে মুক্তি দিতে পারে। এটা শুধু সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপার।

জামিনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা আপিল বিভাগে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি; কিন্তু বেগম জিয়া খুবই অসুস্থ। তাই আবারো হাইকোর্টে জামিন আবেদনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যত দিন আসামি কারাগারে থাকে, তত দিনই জামিন আবেদন করা যায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আরেক আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামিন আবেদনের ক্ষেত্রে আইনি কোনো বাধা নেই।
কারাবন্দী খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবার ও দলের নেতাকর্মীরা। জানা গেছে, পরিবার এবং দলের একটি অংশ যেকোনো মূল্যে তাকে কারামুক্ত করে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে চাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে প্যারোলে মুক্তি নিয়েও তাদের আপত্তি নেই। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সাথে বিএনপির কয়েক নেতা এবং পরিবারের সদস্যরা যোগাযোগ করছেন। আন্তর্জাতিকভাবেও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তারা।

কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করতে তাকে ফোন করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে পর্দার আড়ালের তৎপরতা সামনে চলে আসে। যদিও এই ফোনের বিষয়ে মির্জা ফখরুল স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মির্জা ফখরুল বেগম জিয়ার প্যারোলের জন্য ওবায়দুল কাদেরকে অনুরোধ করেননি। তিনি খালেদা জিয়ার সাজা মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি। মির্জা ফখরুল এ-ও বলেছেন, চেয়ারপারসনের মামলাটি রাজনৈতিক। তাই তার মুক্তির বিষয়টিও রাজনৈতিকভাবেই হতে পারে।
এ দিকে খালেদা জিয়া ছাড়া পরিবার বা অন্য কারো পক্ষে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করা সম্ভব নয়। কারণ এ ক্ষেত্রে আবেদনে খালেদা জিয়ার নিজের অনুমতি বা স্বাক্ষর লাগবে।
বিএনপি ও চেয়ারপারসনের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, প্যারোলে বা সাজা মওকুফের আবেদন করতে এখনো সম্মতি দেননি খালেদা জিয়া। আইনি প্রক্রিয়ার ওপরই জোর দিয়েছেন তিনি। দলের বেশির ভাগ নেতাও প্যারোল বা ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে নয়। তারা মনে করেন, প্যারোলে মুক্তি দেয়া মানে সরকারের সাথে আপস করা।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়ার কারাভোগ করছেন। প্রথম ১১ মাস ছিলেন পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে একমাত্র বন্দী হিসেবে। ‘নির্জন’ এই কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত বছরের ১ এপ্রিল চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে নিয়ে আসা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কেবিন ব্লকে, যেখানে এখনো তিনি চিকিৎসাধীন আছেন।

চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টে ফের খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন : জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে ফের জামিন আবেদন করা হয়েছে। আবেদনে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ, তার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হয়েছে। তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে তার উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে না। তাই জামিন পেলে তিনি উন্নততর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাবেন। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ আবেদনের ওপর শুনানি হতে পারে বলে তার আইনজীবীরা জানান।

গতকাল বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, আইনজীবী সগির হোসেন লিয়ন ও গোলাম আকতার জাকির খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের অ্যাফিডেভিড মঙ্গলবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় দাখিল করা হয়েছে। আজ বুধবার দুদক সংক্রান্ত মামলা শুনানির এখতিয়ার রয়েছে হাইকোর্টের এমন একটি বেঞ্চে আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হবে। এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে হাইকোর্টের দেয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন খারিজ করে দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট।

আপিল বিভাগের আদেশের পর ওই দিন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা পরবর্তীতে নতুন করে জামিন আবেদন করা হতে পারে বলে জানিয়েছিলেন।
গত ৩১ জুলাই বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দেন।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ চার আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। ২০১০ সালের ৮ আগস্ট খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা করে দুদক।

অন্য দিকে খালেদা জিয়ার কারামুক্তির জন্য আরো একটি মামলায় জামিন নেয়ার প্রয়োজন হবে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন। এটি হলো জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। ২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। এরপর থেকে তিনি কারাগারে। এই মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে দায়ের করা আপিলে সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করা হয়, যা আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে।

পিবিএ/এমআর

আরও পড়ুন...