পিবিএ,খুলনা: ‘দু’দিন আগে মানুষের বাড়ি বাড়ি যাইয়ে যা জোগাড় হয়েচে তাতে দিন তিনেক খাতি পারবানে। তারপর কি হবেনে বাপু আল্লা জানে।’ খুলনার কয়রা উপজেলার ঘাটাখালি গ্রামের ষাটোর্ধ জরিনা খাতুন বলছিলেন এভাবে। করোনা প্রতিরোধে সারাদেশের ন্যায় প্রত্যন্ত এ জনপদেও ঘরবন্দী হয়ে পড়েছে মানুষ। রাস্তা-ঘাট জনমানব শূণ্য। কারো বাড়িতেও কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেঁটে খাওয়া মানুষগুলো। অনেকেই আছেন যারা দিনের খাওয়া দিনে জোগাড় করেন তাদের অবস্থা আরো করুন।
বৃদ্ধা জরিনা খাতুন বলছিলেন, তার কেউ নেই। থাকার মধ্যে দুই মেয়ে ছিল তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন একা থাকেন। মানুষের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করেই নিজের খাবার জোগাড় হয় তার। এখন সে উপায়ও নেই। মানুষের বাড়ি ঢুকতে নিষেধ করা হচ্ছে।এমন অবস্থা কেবল জরিনা খাতুনের একার নয়। খুলনা মহানগরী থেকে শুরু জেলার নয়টি উপজেলার চিত্রও একই। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন জেলার প্রত্যন্ত এলাকার হতদরিদ্র বাসিন্দারা।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, খুলনা নগরের ৩১টি ওয়ার্ডে ছোট-বড় মিলিয়ে বস্তির সংখ্যা ৭২৬টি। তাতে বসবাস করছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ। এর মধ্যে লক্ষাধিক রয়েছেন রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইকচালক। এছাড়া নয়টি উপজেলায় রয়েছেন কয়েক লাখ নিম্ন আয়ের শ্রমজীবি মানুষ। এর মধ্যে অনেকেরই প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন জোগাড় করতে হয়। অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তি করেই পরিবার চালান।
খুলনা নগরীর রিকসা চালক মিজান শেখ বলেন, ‘ঘরে বইসে থাকলে তো কেউ আমাগে খাবার দেবে না। আমাদের কর্মতো এ রিকশায়। পুলিশ আমাদের রাস্তায় নামতে নিষেধ করেছে। আমরা তাদের কইছি আমরা যদি ঘরে বইসে থাকি তাইলে আমাগে তো কেউ খাবার দেবে না। আমাগে বাচ্চা-কাচ্চা আছে। রিকশা চালানো ছাড়া তো আর কিছু করি না।
মহানগরের দোলখোলা এলাকার ষাটোর্ধ্ব অপর এক রিকশাচালক আলী আকবার বলেন, ‘মার্কেট বন্ধ। মুদির দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতাশূন্য। কোনো গাড়ি চলছে না। মানুষ বাইরে বের হচ্ছে না। ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন মানুষ। কোনো ভাড়া পাই না। অথচ চাল-ডাল-শাক-সবজি-মাছ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। সংসার চালাতে পারছি না। কেউ কোনো সাহায্যও করছে না।
নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের চা দোকানী মামুন বলেন, ‘ভোটের সমায় আমাগের নেতারা মুখি অনেক কিছু কইছে। এখন দুঃসময়ে তাগের কোন খবর নেই। পুলিশ খালি সচেতন হইতে কয়। এ কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আমরা যারা না খেয়ে আছি। কেউ এসে দু’বেলা খোঁজ নিলো না। কি খেলাম না খেলাম। শুধু দোকান বন্ধ রাখতি কয়। হতদরিদ্র মানুষরা জানান, পেটের জালায় তাদের বাইরে বের হতে হয়। অনেক সময় পুলিশ তাদের অযথা হয়রানি করে। নিরাপদ পোশাক, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাবস পরতে বলেন।
গত বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর মহানগরের রাস্তাঘাট একদম জনশূন্য হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরা মাঠে থাকায় কেউ সাহস করে বাইরে বের হচ্ছেন না। চিরচেনা সেই যানজট ও ফুটপাতে ব্যস্ত মানুষের ছুটে চলা একদম নেই। গলিগুলোতে যাত্রীদের আশায় হাতে গোনা কয়েকটি রিকশাচালক হাঁকডাক দিচ্ছেন যাত্রীর আশায়। কিন্তু সড়কগুলো ফাঁকা ময়দানে পরিণত হয়েছে। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন মানুষ। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে ফুটপাতের হকার, পরিবহনশ্রমিক ও দোকান কর্মচারী সবার একই অবস্থা। মাসের শেষে এসে এ সংকট শুরু হয়েছে। একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে, অন্যদিকে সচ্ছল লোকজন বাসায় খাদ্য মজুদ করেছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) খুলনা জেলা কমিটির সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ লোক যারা দিন আনে দিন খায়। তাদের শুধু ঘরে পাঠিয়ে দিলেই হবে না। তাদের খাদ্যের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। করোনা সংক্রমণের এ সময়ে রিকশাচালকসহ দিনমজুর দরিদ্র মানুষেরা সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন। অতি দ্রুত এ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া শুরু করা উচিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আজ শনিবার থেকে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দরিদ্র মানুষের মাঝে ১০ কেজি করে চাল, এক কেজি আলু, সাবান ও মাস্ক বিতরণ করা শুরু হয়েছে। কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহা জানিয়েছেন, উপজেলার ২৫০ পরিবারকে এ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। অন্য উপজেলাগুলোতেও একইভাবে সহযোগীতা শুরু হয়েছে। তবে এমন আপদকালিন সময়ে যে সহযোগীতা করা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। খুলনা জেলা প্রশাসক মোঃ হেলাল হোসেন জানিয়েছেন, হোম কোয়ারিন্টিনে থাকা পরিবার ও হতদরিদ্রদের সহযোগীতায় সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পিবিএ/শেখ হারুন অর রশিদ/বিএইচ