৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী দোল পুর্ণিমার মেলা জমে উঠেছে

আবুবকর সিদ্দিক, জয়পুরহাট প্রতিনিধি: প্রতিবছর দোলপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে শুরুহওয়া এ মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিক্রেতা ও ক্রেতারা আসেন। ৫১৪ বছরের ঐতিঞ্যবাহী এই মেলায় ঘোড়া, গরু, মহিষ ও বেচাকেনা হয়। কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টান্ন, মাছ, শিশুদের আনন্দের বিভিন্ন খেলাসহ বিভিন্ন সামগ্রী রয়েছে এ মেলায়। করোনা কালীন মেলা বন্ধ থাকায় এবার উপচে পড়েছে ভীড়, আগে এই মেলায় সিনেমা, যাত্রা , সার্কাস , পুতুল নাচ সহ বিভিন্ন প্রকার বিনোদন মুলক খেরা প্রচলন ছিল। কালের আবর্তনে এই মেলায় আর যাএা, পালাগান, সার্কাস আর হয়না। তবে একটি আকর্ষন এখোনো রয়েছে,এই মেলায় ঘোড়া ক্রয় বিক্রয় হয়।

টগবগিয়ে ছুটে চলছে তার পিঠে চেপে বসে আছেন ঘোড় সওয়াররা। ফাঁকা মাঠের একপাশ থেকে অন্যপাশে

ক্রেতাদের দেখানো হচ্ছেঘোড়ার দৌড়। এই দৌড় দেখতে চারপাশে ভিড়জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। এই দৌড় দেখে তারপর ঠিকঠাক হবে দরদাম। ঘোড়ার এমন দৌড় প্রতিযোগিতার দেখা মেলে ৫০০ বছরেরও বেশি সময়ধরে ঐতিহ্য ধারণ করে আসা জয়পুরহাটের গোপীনাথপুর দোল পূর্ণিমা মেলায়।

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলা শহর থেকে ছয়-সাত কিলোমিটার পথ গেলে গোপীনাথপুর ইউনিয়নে অবস্থিত নান্দনিক এই মেলার প্রথমেই চোখ যাবে বিভিন্ন আকার ও রঙের ঘোড়ার দিকে। কোনটা লাল, সাদা, লাল-সাদা, আবার কোনটা কালো রঙের। এখানে ছোট-বড় আর মাঝারি এসব বাহারি ঘোড়া নিয়ে আসা হয় বিক্রির জন্য। কালো মহিষ, লার মহিষ, মহিষের ছোট বাচ্চা, এবং প্রচুর গরু কেনা বেচা হয় এই মেলায়।

।এটি অন্য কোনো বাজারের মতো নয়, বাজারে পশু বিক্রি করেই বাড়ি চলে যাওয়ার সুযোগ নেই এখানে। এই বাজারে বিক্রেতাকে থাকতে হয় অন্তত এক সপ্তাহ। এজন্য পোশাক থেকে শুরু করে রান্নার সরঞ্জাম সবই নিয়ে আসতে হয়। শুধু মানুষের জন্যই নয় পশুদের জন্য খাবারও নিয়ে আসতে হয়। আর সেখানে তাঁবু বানিয়ে নিজে বসবাস করেন আবার পাশেই পশুগুলোকে বেঁধে রাখেন।

বিকেল হলে মেলার একপাশের ফাঁকাস্থানে শুরু হয় ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতা দেখেই ঘোড়ার দরদাম করেন ক্রেতারা। ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে মেলায় আসা দর্শনার্থীরা সেখানে ভিড় জমায়।

আক্কেলপুরের নয়ন নামের এক কলেজ শিক্ষার্থী বলে, সারাদিন এখানে ঘোড়ার দৌড় দেয়। তবে বিকেলে অনেক ঘোড়া এক সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে। আর এটি দেখে খুব ভালো লাগে। তাই বিকেল হলে এখানে ঘোড়ার দৌড় দেখতে চলে আসি।

নাতিকে ঘোড়ার দৌড় দেখাতে নিয়ে আসা মিথন কুমার ঘোষ বলেন, আমার বাড়ি গোপীনাথপুর বাজারে। বিকেল হলে অনেক ঘোড়া এক সঙ্গে দৌড় দেয়। ঘোড়ার দৌড় দেখতে অনেক মানুষ ভিড় জমায়। এটি দেখাতে নাতিকে নিয়ে আসি। এতে নাতি খুব খুশি হয়। এ মেলাকে ঘিরে আশপাশের গ্রামের মানুষদের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনরা বেড়াতে আসেন। মেলায় আসা বিভিন্ন দোকান থেকে নানা সামগ্রী কেনাকাটা করেন।

মেলায় আসা ঘোড়া বিক্রেতা গোলজার রহমানের বয়স প্রায় ৭০ বছর। এই বয়সেও তিনি ঘোড়ার পিঠে চেপে ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা দেখাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি প্রায় ৪৫ বছর যাবৎ এ মেলায় ঘোড়া নিয়ে আসি। ঘোড়া বেচাকেনা করা হয়। এবার আমার একটি ঘোড়ার নাম পঙ্খিরাজ, এর দাম ধরা হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। ক্রেতারা দেড় লাখ পর্যন্ত দাম করছে। আরও কয়েকটি ঘোড়াও আনা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তিনটি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন আব্দুল বারিক। তিনি বলেন, তিনটি ঘোড়ার মধ্যে একটি ছোট আর দুটি বড়। বড় দুটির মধ্যে একটি তাজী ইন্ডিয়ান আর একটি ভুটিয়া ঘোড়া। তাজী ইন্ডিয়ানের দাম চাওয়া হচ্ছে ৭ লাখ ২০ হাজার, আর ভুটিয়া ঘোড়ার দাম ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ক্রেতারা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দাম করছেন।টাংগাইলের মোস্তাকুর শখের বশে ৭ লাখ টাকা দিয়ে একটি ঘোড়া কিনেছেন।

গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী হাবিবুর রহমান পদাধিকার বলে গোপীনাথপুর দোলপূর্ণিমা মেলার সভাপতি। তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় হিন্দু-মুসলমান মিলে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। এ মেলাকে ঘিরে দূর-দূরান্তের অনেক মানুষ আসেন। মেলায় ঘোড়া, মহিষ-গরু বেচাকেনা হয়। এ মেলায় বড় বড় মিষ্টি পাওয়া যায়, একটি মিষ্টি ৩ কেজী থেকে ৫ কেজী পর্যন্ত আছে।। বড় বড় মাছও পাওয়া যায়। জামাইরা আতিথেয়তার জন্য শ্বশুর বাড়িতে মাছ, মিষ্টান্নসহ নানা সামগ্রী কিনে নিয়ে যান। এছাড়াও কাঠে আসবাবপত্র, শিশুদের জন্য ভুতের বাড়ি, ইলেকট্রিক ট্রেন সহ নানা খেলনা রয়েছে। প্রতিদিন পাঁচ লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে থাকে। মেলা যাতে সুন্দরভাবে পরিচালিত হয় এজন্য প্রশাসনের পাশাপাশি মেলা কমিটির পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে।

আক্কেলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে মেলায় চলাচল করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তাছাড়া গোয়েন্দা পুলিশও রয়েছে।

আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তহমিনা আক্তার বলেন, গোপীনাথপুর দোলপূর্ণিমার মেলার তেরো দিনের অনুমতি দেওয়া আছে। মেলা কমিটির পক্ষ থেকে একশ জনের মতো স্বেচ্ছাসেবক আছে। তাছাড়া গ্রাম পুলিশ, আনসার সদস্যরাও রয়েছেন। এছাড়া পুলিশের কয়েকটি টিমও কাজ করছে। মেলায় আগত দর্শনার্থীরা যেন সুন্দরভাবে কেনাকাটা ও ঘুরতে পারে এজন্য সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।১০ ই মাচৃ মেলা শুরু হয়েছে চলবে ১ মাস পর্যন্ত। তবে গরু মহিষ , ঘোড়া, এই মেলা দুই একদিনের মধ্যেই শেষ হবে। উল্লেখ্য ১৩ দিনের অনুমতি থাকলেও ১ মাস এই মেলা চলে।

আরও পড়ুন...