ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি চক্রের মূলহোতাসহ গ্রেফতার ১৪

পিবিএ,ঢাকা: বিভিন্ন কারসাজি করে দেশব্যাপী ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি চক্র উত্তম ও সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতাসহ ১৪ জন সক্রিয় সদস্য’কে রাজধানীর কমলাপুর ও বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৩; অবৈধভাবে সংগ্রহ ও মজুদকৃত ১২শ এর অধিক ট্রেনের টিকেট উদ্ধার।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু দুষ্কৃতিকারী ও টিকেট কালোবাজারি চক্রের দৌরাত্মে স্বস্তিকর রেল ভ্রমণের টিকেট প্রাপ্তি অনেক সাধারণ জনগণের জন্য জন্য অস্বস্তি, চিন্তা ও ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনলাইনে বা রেল স্টেশনের টিকেট কাউন্টারে টিকেট পাওয়া না গেলেও কালোবাজারে অধিক মূল্যে টিকেট বিক্রি হতে দেখা যায়। টিকেট কালোবাজারিরা বিভিন্ন কৌশলে ট্রেনের টিকেট অগ্রিম সংগ্রহ করে অবৈধভাবে নিজেদের কাছে মজুদ করে রেখে সাধারণ যাত্রীদের নিকট দেড় থেকে দুই গুন বেশি দামে টিকেট বিক্রি করছে।

ঢাকা-কক্সবাজার রুটে সরাসরি ট্রেন চলাচল শুরু হয় এবং এই রুটে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ ও ‘পর্যটক এক্সপ্রেস’ নামের দুটি ট্রেন যাত্রা শুরু করে। দীর্ঘ এই ভ্রমণে নিরাপদ ও আরামদায়ক যাত্রার জন্য এ রুটে ট্রেনের টিকিটের ব্যাপক চাহিদা পরিলক্ষিত হয়। টিকেটের চাহিদা বেশি থাকায় টিকেট কালোবাজারিদের দৌরাত্মও বেড়ে যায়; অনলাইনে বা কাউন্টারে টিকেট বিক্রি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় এই রুটের ট্রেনের টিকেট। কিন্তু কালোবাজারিদের কাছে ২-৩ গুন দামে টিকেট বিক্রি হতে দেখা যায়। চাহিদা অনুযায়ী টিকেট না পাওয়ার এবং টিকেট কালোবাজারী কর্তৃক অধিক মূল্যে টিকেট বিক্রয়ের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচিত হয়। ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি প্রতিরোধ ও কালোবাজারিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে র‌্যাব ফোর্সেস।

গতকাল রাতে র‌্যাব-৩ এর আভিযানিক দল রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ট্রেনের টিকেট কালোবাজারির সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা ১। মোঃ সেলিম (৫০), ও তার প্রধান সহযোগী ২। মোঃ আনোয়ার হোসেন ওরফে কাশেম (৬২), ৩। শ্রী অবনী সরকার সুমন (৩৫), ৪। মোঃ হারুন মিয়া (৬০), ৫। মোঃ মান্নান (৫০), ৬। মোঃ আনোয়ার হোসেন ওরফে ডাবলু (৫০), ৭। মোঃ ফারুক (৬২), ৮। মোঃ শহীদুল ইসলাম বাবু (২২), ৯। মোঃ জুয়েল (২৩), ১০। মোঃ আব্দুর রহিম (৩২), এবং উপরিউক্ত আসামিদের তথ্যের ভিত্তিতে বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে উত্তম সিন্ডিকেটের মূলহোতা ১। উত্তম চন্দ্র দাস (৩০), এবং তার প্রধান সহযোগী ২। মোঃ মোর্শিদ মিয়া ওরফে জাকির (৪৫), ৩। আব্দুল আলী (২২), ও ৪। মোঃ জোবায়ের (২৫)-কে গ্রেফতার করা হয়।

উদ্ধার করা হয় ১২৪৪টি আসনের টিকেট, ১৪টি মোবাইল ফোন এবং টিকেট বিক্রয়ের নগদ ২০,০০০/- টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা ট্রেনের টিকেট কালোবাজারির সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।

গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, কমলাপুর রেলস্টেশনে সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত সেলিম এবং বিমানবন্দর রেলস্টেশনে উত্তম সিন্ডিকেটের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত উত্তমের নেতৃত্বে এই চক্রটি সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন যাবত মহানগর প্রভাতী, তূর্ণা নিশিথা, চট্টলা এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস, উপকূল এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি করে আসছিল।

গ্রেফতারকৃত সেলিম এবং উত্তম এর নেতৃত্বে তার সহযোগিরা প্রথমত ট্রেনের কাউন্টারে বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ যাত্রী, রেলস্টেশনের কুলি, স্টেশনের আশেপাশের এলাকার টোকাই, রিক্সাওয়ালা ও দিনমজুরদেরকে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে লাইনে দাড় করিয়ে টিকেট সংগ্রহ করে থাকে। এই ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেককে ০৪ টি করে টিকেট সংগ্রহ করার বিনিময়ে ১০০ টাকা করে দেয়া হতো।

এছাড়াও কাউন্টারে থাকা কিছু অসাধু টিকেট বুকিং কর্মচারীদের দিয়ে বিভিন্ন সাধারণ যাত্রীদের টিকেট কাটার সময় প্রদেয় এনআইডি সংগ্রহ করে রাখে এবং পরবর্তীতে সেগুলো ব্যবহার করে সংরক্ষণকৃত প্রতিটি এনআইডি দ্বারা ০৪ টি করে ট্রেনের টিকেট সংগ্রহ করে থাকে। এভাবে তারা প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শতাধিক টিকেট সংগ্রহ করতো। অনেক ক্ষেত্রে টিকেট কাউন্টারে নিজেরা লাইনে দাড়িয়ে এবং কৌশলে লাইনে অপেক্ষমান টিকেট প্রত্যাশী সাধারণ যাত্রীদের এনআইডি ব্যবহার করে ৪টি টিকেট ক্রয় করে ৩টি টিকেট নিজেরা তার কাছ থেকে টাকা দিয়ে টিকেটগুলো কিনে নিতো।

এছাড়াও ঈদ, পুজা, সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিশেষ ছুটির দিনকে উপলক্ষ করে গ্রেফতারকৃতরা রেলস্টেশনে কর্মরত কিছু অসাধু কর্মচারী এবং অনলাইনে টিকেট ক্রয়ের জন্য ব্যবহৃত ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান সহজ.কম এর কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও সার্ভার রুম/আইটি এর সদস্যদের সহযোগিতায় তাদের কাছে সংরক্ষিত জনসাধারণের এনআইডি এর তথ্য ব্যবহার করে এমনকি সার্ভার ডাউন করে তারা অনলাইনে টিকেট সংগ্রহ করতো। পাশাপাশি গ্রেফতারকৃতরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দিয়ে অনলাইনে টিকেট কেটে সেগুলো তাদের নিকট থেকে সংগ্রহ করতো।

গ্রেফতারকৃতরা স্টেশনে থাকা তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যদের দিয়ে কাউন্টার থেকে স্ট্যান্ডিং টিকেট সংগ্রহ করতো। উক্ত টিকেটের মূল্য কাউন্টারের বুকিং কর্মচারীদের সাথে তারা ভাগ করে নিতো। ফলে রেলওয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এভাবে গ্রেফতারকৃতরা অবৈধভাবে বিভিন্ন পন্থায় বিপুল সংখ্যক ট্রেনের টিকেট সংগ্রহ করতো বলে জানায়।

গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত সেলিম ও উত্তম এর নেতৃত্বে তার সহযোগীরা উপযুক্ত সময় বুঝে সংগ্রহকৃত টিকেট নিয়ে রেলস্টেশনের ভিতরে অবস্থান করে। রেলস্টেশনে এসে টিকেট না পাওয়া সাধারণ যাত্রীদের নিকট গ্রেফতারকৃতরা টিকেট বিক্রির জন্য ঘুরাঘুরি করে এবং অধিক মূল্যে টিকেট বিক্রি করে থাকে। এছাড়াও ট্রেন ছাড়ার সময় সন্নিকটে আসতে থাকে তাদের মজুদকৃত কালোবাজারি টিকেটের দাম তত বৃদ্ধি পেয়ে থাকে এবং সুযোগ বুঝে অনেক ক্ষেত্রে টিকেটের দাম দিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে দেয়।

ঈদের ছুটিসহ বিভিন্ন ছুটিকে কেন্দ্র করে গ্রেফতারকৃতরা প্রতিটি টিকেট ৩-৪ গুন বেশি মূল্যে বিক্রয় করে থাকে। প্রতিটি টিকেট তারা দেড় গুণ থেকে দুই গুণে বিক্রি করে এই লভ্যাংশের ৫০ শতাংশ পায় গ্রেফতারকৃতরা নিতো এবং বাকি ৫০ শতাংশ কাউন্টারে থাকা বুকিং কর্মচারী ও তাদের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, সহজ ডট কমের কর্মচারী-কর্মকর্তা ও আইটি বিশেষজ্ঞদের দেয়া হতো। গ্রেফতারকৃত উত্তম ও সেলিম সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন যাবত টিকেট কালোবাজারির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানায়।

গ্রেফতারকৃত সেলিম দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর যাবত টিকেট কালোবাজারির সাথে জড়িত। সে কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় টিকেট কালোবাজারির দায়ে ৭টি মামলা রয়েছে এবং উক্ত মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে। সে জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় আবার টিকেট কালোবাজারির কার্যক্রমে লিপ্ত হয়।

গ্রেফতারকৃত মোঃ আনোয়ার হোসেন ওরফে কাশেম প্রায় ১৫ বছর যাবত ট্রেনের টিকেট কালোবাজারির সাথে জড়িত। সে গ্রেফতারকৃত সেলিম এর অন্যতম প্রধান সহযোগী। মূলত তার দায়িত্ব ছিল কাউন্টার থেকে ট্রেনের টিকেট সংগ্রহ করা। ইতিপূর্বে সে মাদক মামলাসহ একাধিক মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়।

এছাড়াও গ্রেফতারকৃত অবনী সরকার ও হারুন মিয়ার দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম এলাকার কাস্টমার সংগ্রহ করা। একইভাবে মান্নান এবং আনোয়ার ওরফে ডাবলুর দায়িত্ব ছিল সিলেট এলাকার কাস্টমার সংগ্রহ করা। ফারুক এবং শহীদুল ইসলাম বাবুর দায়িত্ব ছিল ভৈরব ও কিশোরগঞ্জের কাস্টমার দেখাশোনা করা। জুয়েল এবং আব্দুর রহিমের দায়িত্ব ছিল ব্রাহ্মনবাড়িয়া ও আখাউড়ার যাত্রী সংগ্রহ করা। এছাড়াও গ্রেফতারকৃতদের প্রায় সকলের বিরুদ্ধে টিকেট কালোবাজারির মামলা রয়েছে।

গ্রেফতারকৃত উত্তম প্রায় ১৫ বছর যাবত ট্রেনের টিকেট কালোবাজারির সাথে জড়িত। সে বিমানবন্দর রেলস্টেশনের টিকেট কালোবাজারি চক্র উত্তম সিন্ডিকেটের মূলহোতা। তার সহযোগী গ্রেফতারকৃত আলী ও ফারুকসহ রাজধানীর আশকোনা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় অবস্থান করে এসকল কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সে শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং এই সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে রেলস্টেশন এলাকায় সব সময় অবস্থান করে টিকেট কালোবাজারি চক্র গড়ে তোলে। তার বিরুদ্ধে টিকেট কালোবাজারির দায়ে ৪টি মামলা রয়েছে। উক্ত মামলায় সে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়। সে জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় টিকেট কালোবাজারির কাজে লিপ্ত হয়।

গ্রেফতারকৃত মোঃ মোর্শেদ মিয়া স্থানীয় একটি কলেজ হতে ডিগ্রি সম্পন্ন করে। সে প্রায় ০৫ বছর যাবত গ্রেফতারকৃত উত্তমের প্রধান সহযোগী হিসেবে টিকেট কালোবাজারির সাথে জড়িত। তার মূল দায়িত্ব ছিল অনলাইনে টিকেট প্রত্যাশীদের সাথে টিকেটের দর কষাকষি করে দাম নির্ধারণ করা। টিকেট কালোবাজারির মামলায় সে ইতিপূর্বে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়। এই চক্রের অপর সদস্য আব্দুল আলীর দায়িত্ব ভৈরব ও কিশোরগঞ্জের, মোঃ জুবায়ের এর দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম ও সিলেট এলাকার যাত্রী সংগ্রহ করা।

গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

আরও পড়ুন...