এসকে রেজা পারভেজ : তার রাজনীতি ছিলো দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে। কিভাবে বাংলার মানুষকে পাকিস্তানি শোষণ থেকে মুক্ত করবেন, সেজন্য ছুটে বেরিয়েছেন বাংলার আনাচে-কানাচে, পথে প্রান্তরে। ভালোবেসে মানুষ কতো নামে ডেকেছে তাকে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় ‘মুজিব ভাই’।
১৯৬৬ সাল থেকে তার নামের আগে তরুণ সমাজ ‘সিংহশার্দূল’, ‘বঙ্গশার্দূল’ ইত্যাদি খেতাব জুড়ে দিতে থাকে। তবে ‘মুজিব ভাই’, ‘শেখের বেটা’, ‘বাংলার মুজিব’, ‘শেখ মুজিব’, ‘বঙ্গশার্দূল’, ‘সিংহশার্দূল’-এ সবকিছু ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার বন্ধু। বাংলাদেশের মানুষের বন্ধু। আর সব নাম ছাপিয়ে তিনিও হয়ে ওঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’।
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র সব সময়েই তাকে ঘিরে রেখেছিলো। সংগ্রাম-আন্দোলনে বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখতে শেখ মুজিবুর রহমানকে শত শতবার কারাগারে পাঠায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। দায়ের করা হয় একের পর এক মিথ্যা মামলা। তেমনই এক মামলা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।
১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার অভিযোগ আনে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং কয়েকজন সাধারণ সৈনিক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। এই মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। ৩৫ জন আসামির সবাইকে পাকিস্তানি সরকার গ্রেপ্তার করে।
বাংলার প্রাণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের পর ফুঁসে ওঠে বাংলার মানুষ। তৎকালীন শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে রাজপথে নামে ছাত্র-জনতা। উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ। আন্দোলনের দাবানল দেখে আঁতকে ওঠে স্বৈরাচারের চেয়ার। মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্তদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী।
মূলতঃ বাঙ্গালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা দেয়ার কারণেই বঙ্গবন্ধুসহ সর্বমোট ৩৫ জনকে ফাঁসি দেয়ার লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয়। ফের ক্ষমতায় আসতে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন আইয়ুব খান। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ১৯৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু’ কার্যালয়ে তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর ব্যানারে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। কিন্তু এই সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল করে ছাত্র সমাজ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনারা বেয়নেট চার্জে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই হত্যাকাণ্ডের পর আইয়ুব খান সান্ধ্য আইন জারি করেন। এর প্রতিবাদে ২০ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা নগরী মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তখন সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের মহাসমুদ্রে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ গ্রেপ্তার করা সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয় ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। বাধ্য হয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হন আইয়ুব খান।
২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেখানে তৎকালীন ডাকসুর সভাপতি, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকে বাংলার জনগণের কাছে তিনি শেখ মুজিবুর রহমান নাম ছাপিয়ে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে।
এ সম্পর্কে এক লেখায় বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু উপাধি ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
তবে ১৯৮৭ সালের ৩১ জুলাই দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত কলামিস্ট ওবায়দুল কাদেরের (ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি ও বর্তমান সেতু ও যোগাযোগমন্ত্রী) এক লেখায় পাওয়া যায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রথম দিয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতা রেজাউল হক মুশতাক।
ওবায়দুল কাদের লেখেন, ‘মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত হন লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশে, ১৯৬৯ সালে। অবিস্মরণীয় গণবিস্ফোরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে সে আন্দোলনের অগ্রণী বাহিনী ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবকে রেসকোর্সের স্বতঃস্ফুর্ত বিশাল জনসমুদ্রে ডাকসুর সহ-সভাপতি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা তোফায়েল আহমদ ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেন। সেটা অবশ্য আরও পরের ঘটনা। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কার মাথায় প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি এসেছিল।
এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে খানিকটা পেছনে যেতে হয়। তখন সম্ভবত ১৯৬৭ সাল। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ ‘প্রতিধ্বনি’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা বের করতো। সে পত্রিকার একটি ইস্যুতে ছাত্রলীগের রেজাউল হক মুশতাক ‘সারথী’ ছদ্মনামে ‘আজবদেশ’ নামে একটি লেখা লেখেন। লেখাটার শেষ দিকে ‘বঙ্গশার্দুল’ শেখ মুজিবের পাশে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে একই পত্রিকায় ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসের ইস্যুতে ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তাবিত পূর্ব বাংলার ‘মুক্তিসনদ’ ৬ দফা শিরোনাম হয়ে আসে। তখন অবশ্য ছোট হেডিংয়ে অখ্যাত এক পত্রিকায় ব্যবহৃত ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ঢাকার ছাত্র মহলের একাংশ ছাড়া অন্য কারও নজর কাড়েনি।
পিবিএ/জেআই