ক্ষমতাসীনরা বর্গীদের মতো লুট করতে টপ টু বটম ব্যস্ত: রিজভী

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সরকারের লোকেরা বর্গীদের মতো লুটের রাজ্য ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে টপ টু বটম ব্যস্ত। বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) বিকেলে ভার্চুয়ালি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় থাকে দেশকে লুটপাট করে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করে। আওয়ামী লীগ হচ্ছে চোরের ফ্যাক্টরি। তাদের নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। আমার ডানে চোর, বাঁয়ে চোর, সামনে চোর, পেছনে চোর, চোর আর চোর। আমি বিদেশ থেকে যা কিছু আনি এই চোর-চাটার দল সব খাইয়া ফেলায়।’ গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার বিনা ভোটের রাজত্বে তার মন্ত্রী-এমপি-বড় নেতা, ছোট নেতা, পাতি নেতা, খুঁদে নেতা সবাই লুটপাটের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়েছেন। দুর্নীতি, লুটপাট, নৈরাজ্যের স্বর্গ গড়েছেন তারা। তারা জনগণের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো বসে ক্ষমতাকে ‘মধুর, তোমার শেষ যে না পাই, প্রহর হল শেষ এর পরামান্দের অনুভূতি নিয়ে উপভোগ করছেন। আর শেখ হাসিনা বলছেন, বিএনপি নাকি আগামী মার্চ মাসে দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। কি হাস্যকর রঙ্গ-ব্যঙ্গ! আসন্ন একদলীয় পাতানো নির্বাচন উপলক্ষে তাদের মন্ত্রী-এমপি-ডামি-উচ্ছিষ্টভোগী স্বতন্ত্রদের হলফনামা পড়লে মনে হয় যেন রুপকথার আলাদিনের চেরাগের কাহিনী পড়ছি। কারো কারোটা দেখলে মনে হয় সাদ্দাদের বেহেস্তে তারা বসবাস করছি।

তিনি বলেন, নিশিরাতের সরকারের ৫ বছর থেকে ১৫ বছরের মধ্যে মন্ত্রী-এমপি এবং তাদের নেতারা অর্থসম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। অনেকে প্রায় কপর্দকহীন থেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ নয়, বটগাছ হয়েছেন। তাদের স্ত্রী-সন্তান-শাশুড়িরাও টাকার কুমিরে পরিণত হয়েছে। সাধারণ ব্যবসায়ীদের লোকসান হলেও আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকদের কোনো লোকসান নেই। আওয়ামী রাজনীতি এমন একটি ব্যবসা যেখানে কোনো ঝুঁকি নেই এবং লোকসান হওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই। যে ব্যবসাই করছেন তাতেই লাভ আর লাভ। শেয়ার ব্যবসায় তারা কেউ ক্ষতির মুখোমুখি হননি। কৃষিখামার এবং মাছের ব্যবসাতেও বহু গুণ লাভ করেছেন। স্বামীদের ব্যবসা দেখাশোনা করতে গিয়ে স্ত্রীরাও কোটি কোটি টাকা, অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন।

হলফনামা ধরে প্রতিদিন প্রাত্যহিক সংবাদপত্রে নির্বাচনের প্রার্থীদের সম্পদের যে বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছে তা দেখে জনগণের চক্ষু চড়কগাছের অবস্থা। তারা ভাবতে থাকে, আমরা কি একটা বাস্তব জগতে বাস করছি নাকি কল্পনার স্বর্গরাজ্যে বাস করছি! এটাও সম্ভব! একেকজন মানুষের সম্পদ ২০০ গুণ, ৩০০ গুণ, ৪০০ গুণ ৫০০ গুণ, কেউ আবার পাঁচ বছরে ৭০০ গুণ সম্পদেরও মালিক হয়েছেন।

অবস্থা এমন হয়েছে যে, টাকার পাহাড়ে ঘুমান মন্ত্রী-এমপি-নেতারা। যে মন্ত্রী-এমপি নিজেকে কৃচ্ছতা সাধনের বরপুত্র বলে জাহির করতেন কিংবা যিনি জনসমুখে সততার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের নাটক করতেন তাদের সততার বিভৎস বিগ্রহ জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। যারা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তাদের প্রায় সকলেরই নগদ অর্থকড়ি-বিত্ত সম্পদ দ্বিগুণ থেকে প্রায় হাজার গুণ স্ফীত হয়েছে। আওয়ামী জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় কারো হয়েছে সম্পদের পাহাড় কারো গাড়ির বহর। দশ বছর আগে যে মন্ত্রীর হলফনামায় হাজারের ঘরে ছিল বার্ষিক আয় তিনিও এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। সবাই জানি তাদের হলফনামায় সম্পদের সামান্যই প্রকাশ পেয়েছে। অবৈধ অর্থ, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ, সেকেন্ড হোম, বিদেশী গচ্ছিত বেশুমার সম্পদের হিসাব নেই। যারা আওয়ামী লীগ করেন তাদের ব্রতই যেন লুটপাট করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া। লুটেরা রাজ্যে আওয়ামী লুটেরাদের কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না। ফলে মোট সম্পদের ছিটেফোঁটা মাত্র এই হলফনামায় উঠে এসেছে। এমপি-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং স্বতন্ত্রপ্রার্থীরাও অনেক তথ্য গোপন করছেন।

তিনি বলেন, অর্থ বিত্ত সম্পদের ছিটেফোঁটার হিসাব দিলেও কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি তাদের হলফনামায় দেশকে শায়েস্তা খার আমলে ফিরিয়ে নিয়েছেন। যে শাসনামলে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেতো। শেখ হাসিনার আদর্শিক কিছু অটোপাস এমপি জনগণকে ব্যাকুব মনে করে। লুটের অর্থ সম্পদ কম দেখাতে তাদের প্রায় সকলেই গাড়ি, বাড়ি, জমি-জিরাত-খামার-বাড়িভাড়া, সোনা-দানা-অলঙ্কারসহ সবকিছুর মুল্য অতি সামান্য দেখিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছে তারা এখনো শায়েস্তা খার আমলে বাস করছেন। সিলেট-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দলটির জেলা সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী হলফনামায় তার ১০০ ভরি স্বর্ণের দাম দেখিয়েছেন মাত্র ১ লাখ টাকা। সে হিসাবে তার কাছে গচ্ছিত প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম পড়েছে ১ হাজার টাকা। কুমিল্লা-৭ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এমপি ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ২২ ভরি স্বর্ণের দাম দেখিয়েছেন ২১ হাজার টাকা। প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম দেখিয়েছেন ৯৫৫ টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে স্বর্ণের ভরি লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কেউ কেউ ঢাকার অভিজাত এলাকার ফ্লাটের দাম লাখ টাকা দেখিয়েছেন। কেউ কেউ মৎস্য চাষের জমির দাম দেখিয়েছেন হাজার টাকা। তবে তাড়াতাড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে সম্পদ ও নগদ অর্থ বৃদ্ধির পেছনে আয়ের উৎসগুলো যে দুর্নীতি লুটপাট তা জনগণ পরিপূর্ণ ওয়াকেফহাল। বাস্তবতা হলো মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের এই সম্পদ-এই টাকার পাহাড় কিভাবে গড়ে উঠেছে আয়ের উৎস কি এসব নিয়ে শেখ হাসিনার মাথাব্যাথা নেই। জবাবদিহিতা নেয়ার কেউ নেই। কারণ, সবকিছু আওয়ামীময়-নষ্টদের অধিকারে। বর্গীদের মতো লুটের রাজ্য ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে টপ টু বটম ব্যস্ত। তারা জনগণের সম্পদ চেটেপুটে খেয়ে পেট মোটা করতে এসেছেন। লুটের শাসন স্থায়ী করতে খুন-গুম, হামলা-মামলা গ্রেফতার মিথ্যা সাজা দেয়া হচ্ছে। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। একতরফা নির্বাচনের নাটক করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে অন্ধ হয়ে পড়েছে।

বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, আওয়ামী মাফিয়া রাষ্ট্রে এমপি বা মন্ত্রিত্ব যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’। এই শাই শাই করে চোখের পলকে শানৈ উন্নতি, অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ার নেপথ্য রহস্য জানে প্রতিটি মানুষ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন তার ছোট্ট উদাহরণ। প্রতিটি মন্ত্রী-এমপির বিমূর্ত অবয়ব তিনি।

প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার জন্য দেয়া ৯৪ লাখ ঘুষের টাকা ফেরত চাওয়ায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের হাতে তার মিন্টো রোডের ১১ নম্বর সরকারি বাসভবনে নির্মম মারধরের শিকার হয়েছেন পুলিশ সদস্যসহ তিন ভূক্তভোগী অসহায় ব্যক্তি। প্রতিমন্ত্রীর নিয়োগ বাণিজ্য ও গুন্ডামির এই খবর সকল পত্র পত্রিকা টেলিভিশন অনলাইনে ভাইরাল হওয়ার পর টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে ১০ ডিসেম্বর সাতজনের কাছ থেকে নেয়া সাড়ে ৯ লাখ টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন প্রতিমন্ত্রী।

১২ ডিসেম্বর যুগান্তরসহ বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন মন্ত্রিত্ব পেয়েই হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। কুড়িগ্রাম থেকে নির্বাচিত এই সংসদ-সদস্য প্রতিমন্ত্রীর পদ পেয়েই অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। সীমান্তবর্তী রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারীতে মাদক ব্যবসা, ভূমিদস্যুতা, তদবির বাণিজ্য ও শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। রাতের আঁধারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামে জমি দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাসহ অবৈধ সম্পদ দখলের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী সুরাইয়া সুলতানা ১৪ বছর ধরে কর্মস্থলে না গিয়েও নিয়মিত তোলেন বেতনভাতা। মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় এলাকার ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন তার পরিবারের সদস্যরাও। অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাহারাদার হিসাবে এলাকায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী।

তবে একজন মাত্র জাকির হোসেনের এই সামান্য অবস্থা। প্রতিটি মন্ত্রী ও এমপির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ গুমরে মরছে। প্রকাশের সাহস পায় না কেউ। জাকির হোসেনের অপকর্মের ফিরিস্তি শেখ হাসিনা জানলেও তার কিছুই হয় না। কারণ, তিনি এদেরকেই পছন্দ করেন। তিনি হেসে খেলে দিব্যি বহাল তবিয়তে আছেন। মন্ত্রীসভার মিটিংও করছেন। এসব দুর্নীতি লুটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দুদক নামে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান যেটাকে দলকানা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়েছে। যাদের কাজ হলো খুঁজে খুঁজে বিএনপি এবং ভিন্নমতের সম্মানিত লোকদের ঘায়েল করা। রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে এই তথাকথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে।

সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ বাহিনী কর্তৃক হামলা, মামলা ও গ্রেফতারের বিবরণ তুলে ধরেন রিজভী।

আরও পড়ুন...