পিবিএ, ঢাকা: সময়ে অসময়ে সবিতার কাছে টাকা চাইতো ইয়োগেন। টাকা না দিলে ইয়োগেন সবিতাকে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন করত। কারন সখিনা বেগম সবিতার (২৬) দায়ের করা এক মামলায় সাক্ষী ছিল নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী ইয়োগেন গোন সালভেস। সাক্ষি হবার জন্য এই আর্থিক সুবিধা নিতো । এক পর্যায়ে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। চরম বিরক্ত ও রাগান্বিত হয়ে ইয়োগেনকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি হত্যা করে সবিতা।
ইয়োগেন হত্যার সন্দেহভাজন আসামী সবিতাকে শনিবার রাত ১১টার দিকে রাজধানীর উত্তর মুগদা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব ৩। র্যাবের কাছে ইয়োগেনকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে সবিতা।
সবিতাকে গ্রেতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
রোববার বিকেলে কাওরান বাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান।
তিনি জানান, গাজীপুরের পূবাইলের মৃত সেকান্দার আলী ভূঁইয়ার মেয়ে সবিতা। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করে ঢাকা জজ কোর্টে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। এছাড়া ঢাকার একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন ।
এমরানুল হাসান জানান, স্ট্যামফোর্ডের ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে পড়ার সময় ২০১৩ সালে অ্যাডভোকেট জাফর উল্ল্যাহ রাসেলের সঙ্গে পরিচয় হয় সবিতার। সেসময় সবিতাকে ক্যাম্পাসে র্যাগিং করে জাফর। পরে অবশ্য এসব মিটে গেলে দুজনের মধ্যে সখ্যতা তৈরি হয়। এর এক পর্যায়ে জাফর নিজের গড়া ‘পুওর পিপলস্ হেল্প ফাউন্ডেশন (পিপিএইচএফ)’ নামের প্রতিষ্ঠানে সবিতাকে কাজ করার জন্য আহ্বান জানায় এবং আজীবন রক্তদাতা হিসেবে সদস্য করে। একই প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতো ইয়োগেন। কিছুদিন পর এই প্রতিষ্ঠানে জাফর উল্ল্যাহর দ্বারা হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হন সবিতা। এদিকে বিভিন্ন বিষয়ে জাফর ও ইয়োগেনের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়।
২০১৭ সালে জাফর উল্ল্যাহর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সবিতা। আর এই মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন ইয়োগেন। সাক্ষী হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন সময় সবিতার কাছে টাকা দাবি করত ইয়োগেন। টাকা না দিলে ইয়োগেন সবিতাকে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন করত।
জাফরের বিরুদ্ধে সবিতার মামলার সাক্ষী হওয়ায় ইয়োগেনকে তার রোষ থেকে আড়াল করতে চাইছিল সবিতা। এজন্য এ মাসে ইয়োগেনের জন্য রাজধানীর সবুজবাগে বাসা ভাড়া নেন তিনি। আগামী মার্চ মাসে ওঠার শর্তে বাড়িওয়ালাকে ফেব্রুয়ারির শুরুতে ভাড়া বাবদ ৫ হাজার টাকা অ্যাডভান্স করেন সবিতা। এ বাসার ভাড়া দুজনে শেয়ার করার কথাও ছিল তাদের।
কিন্তু গত ২ ফেব্রুয়ারি ইয়োগেন মার্চের ভাড়া বাবদ অ্যাডভান্স ৮ হাজার টাকা সবিতার কাছে দাবি করে। এছাড়াও মোবাইল বিল ও নেশার টাকা বাবদ প্রতিদিনই ইয়োগেন ২-৩ বার করে সবিতার কাছে টাকা চাইতো। এই জ্বালাতন থেকে বাঁচতে ইয়োগেনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বলে র্যাবকে জানিয়েছেন সবিতা।
সুপরিকল্পিতভাবে ইয়োগেনকে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, ‘সবিতা চরম বিরক্ত ও রাগান্বিত হয়ে ইয়োগেনকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এজন্য গত ৫ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকা হতে ৪৫০ টাকা দিয়ে কালো ও সবুজ রংয়ের ১টি ব্যাগ এবং ৬৫০ টাকা দিয়ে ১টি বঁটি কিনে আনে এবং ইয়োগেনকে হত্যা করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ইয়োগেন সবিতার সঙ্গে কোর্টে দেখা করতে রাজি হয়। তারপর ইয়োগেনকে সঙ্গে করে তার ভাড়া করা বাসায় যাওয়ার কথা বলে সবিতার তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়। এরপর ইয়োগেনকে হিরাঝিল গলির মাথায় সাড়ে তিনটার দিকে অপেক্ষা করতে বলে। বাসাবো টেম্পুস্ট্যান্ড থেকে একটি লাচ্ছি কিনে সবিতা এবং মুগদা হাসপাতালের টয়লেটে গিয়ে বোরখা পড়ে হিরাঝিল গলির মাথায় আসে। সেখানে আসার পর ইয়োগেনসহ তাদের ভাড়া বাসায় যায়।
সবিতার দেওয়া তথ্য ও র্যাবের নিজস্ব অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা হত্যাকাণ্ডের বিবরণ সম্পর্কে এমরানুল হাসান বলেন, বাসায় প্রবেশের পর ইয়োগেনের পিপাসা পাওয়ায় জুস কিনতে বাইরে যায়। এই ফাঁকে সবিতা আগে থেকে কিনে রাখা লাচ্ছির সঙ্গে চেতনানাশক ঔষধ মিশিয়ে রাখে। ইয়োগেন জুস কিনে বাসায় ফেরার পর একটি প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম গ্লাসে করে এই লাচ্চি ইয়োগেনকে খেতে দেয় সবিতা। ইয়োগেন চেতনানাশক ওষুধ মেশানো লাচ্চি খেয়ে অচেতন হয়ে পড়লে তার হাত-পা-মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলে সবিতা। তারপর বঁটি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে সবিতা। কোপানোর একপর্যায়ে ইয়োগেন চিৎ অবস্থা হতে উল্টে যায়। তখন সবিতা তার পিঠের ওপর এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত করার পর সবিতা সেলোয়ার কামিজ ও ওড়না পরে খালি পায়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।
স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে ইয়োগেনের হাত পা মুখ বাঁধা অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে সবুজবাগ থানা পুলিশ। পরদিন ভোরে নিহতের বোন ডালিন সিল গোনছালভেজ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। থানা পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-৩ ছায়া তদন্ত শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রাত ১১টার দিকে মুগদা থেকে সবিতাকে আটক করা হয়।
পিবিএ/আরআর/জেডআই