নৌ শ্রমিকদের কর্মবিরতি: সাগর ও নদীপথে পণ্য পরিবহনে অচলাবস্থা

চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে জাহাজে ৭ শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদসহ বিভিন্ন দাবিতে লাইটার জাহাজের শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে সারাদেশে সাগর ও নদীপথে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে পণ্য পরিবহন বন্ধ রয়েছে। ফলে ঘাট ও বন্দরের বহির্নোঙরে গম, মসুর ডাল, মটর ডাল, সয়াবিন বীজ, সার, কয়লা ও সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার ইত্যাদি প্রায় ১৫ লাখ টন পণ্য আটকা পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা।

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে এই কর্মবিরতি শুরু করেন নদীপথে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটার জাহাজের শ্রমিকেরা। সোমবার মেঘনা নদীতে লাইটার জাহাজের সাতজনকে খুনের ঘটনার বিচার ও নৌপথে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে এ কর্মবিরতি পালন করছেন তারা।

সাত খুনের ঘটনার পরপরই প্রশাসনের কাছে চার দফা দাবিতে ৭২ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল নৌযান ফেডারেশন। এই চার দফা দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাত খুনের ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার করে বিচার, নৌপথের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান। তবে এ নিয়ে প্রশাসন কোনো আলাপ-আলোচনা করেনি সংগঠনটির সঙ্গে। ফলে কর্মবিরতি শুরু হয়ে যায়।

গণমাধ্যমে পাঠানো এক এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম বলেন, চাদপুরে মেঘনা নদীতে হরিনা ঘাটের কাছে মাঝেরচর এলাকায় এম. ভি. আল-বাখেরা জাহাজে সন্ত্রাসী কায়দায় নির্মম হত্যাকাণ্ডে মাস্টার সহ ৭ জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন, হত্যাকারীদের সনাক্ত করে গ্রেপ্তার, সকল নৌপথে সন্ত্রাস চাঁদাবাজি ডাকাতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন ২৬ ডিসেম্বর রাত ১২:০১ মিনিট থেকে মালবাহী, তৈল-গ্যাসবাহী, বালুবাহীসহ সকল প্রকার পণ্যবাহী নৌযানের শ্রমিকরা লাগাতার কর্মবিরতি শুরু করে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি সফল করতে সব নৌযান শ্রমিকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন তারা। তবে যাত্রী সাধারণের দুর্ভোগের বিষয় বিবেচনা করে সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান কর্মবিরতির আওতামুক্ত থাকবে।

চট্টগ্রাম বন্দর ও লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের তথ্য অনুযায়ী, কর্মবিরতির কারণে দেশের ৪৫টি ঘাটে ৭৩৮টি জাহাজে আটকা পড়ে প্রায় ১০ লাখ টন পণ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জাহাজ আটকা পড়েছে যশোরের নওয়াপাড়া ঘাট, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ঘাট, মেঘনা ঘাট ও সিরাজগঞ্জের ঘোড়াশাল ঘাটে। এ ছাড়া বন্দরের বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে ৩৫টি জাহাজে বোঝাই করা হয়েছিল অর্ধলাখ টন পণ্য, যা আটকে আছে। আবার বন্দরের বহির্নোঙরে ২০টি বড় জাহাজে খালাসের অপেক্ষায় আটকে আছে প্রায় সাড়ে চার লাখ টন পণ্য।

কর্মবিরতির কারণে বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় থাকা ২০টি বড় জাহাজে পণ্য আমদানি বাবদ আমদানিকারকদের ক্ষতিপূরণ গুনতে হতে পারে। বিদেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসা এসব বড় জাহাজ থেকে নির্দিষ্ট সময়ে বা প্রতিদিন ন্যূনতম হারে পণ্য খালাসের চুক্তিতে পণ্য পরিবহন ভাড়া ঠিক হয়। পণ্য পরিবহন ব্যাহত হলে চুক্তির শর্ত রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়।

এদিকে ধর্মঘটের কারণে বন্ধ রয়েছে পায়রা বন্দরের পণ্য খালাস কার্যক্রম। বৃহস্পতিবার রাত থেকে বন্দরের আউটারে এবং ইনারে থাকা সকল মাদার ভ্যাসেল ও লাইটারেজ থেকে পণ্য খালাস কার্যক্রম বন্ধ রাখে শ্রমিকরা। পায়রা বন্দরের ট্রাফিক বিভাগের উপ-পরিচালক ও মিডিয়া উইংস আজিজুর রহমান এই বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নৌযান শ্রমিকেরা যেসব দাবি জানিয়েছেন, তা বাস্তবায়নে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। জাহাজের সাত খুনের ঘটনায় খুব দ্রুত আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনায় কারা নেপথ্যে রয়েছে, তারও তদন্ত চলছে। নৌপথে কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এর পরও তাদের সঙ্গে রোববার বসে আলোচনা করার জন্য বলেছি আমরা। তার আগে কর্মবিরতি যাতে প্রত্যাহার করা হয়, সে জন্য আমরা নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের নেতাদের আহ্বান জানিয়েছি। আশা করছি, তারা দ্রুত কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেবে। কারণ, কর্মবিরতিতে দেশেরই ক্ষতি হচ্ছে। পণ্য খালাস না হলে বড় জাহাজের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

আরও পড়ুন...